ভ্রমণ পাগল
একজন ভ্রমণ পাগল

যারা কঠিন পথকে সহজ করে সফল হয়েছে, তাদের জীবন খুবই আনন্দময়। সফলতার মূলমন্ত্র আমাদের শিক্ষা দেয়, “সফলতা আসবেই, সফলরা হাসবেই।” সফল হতে চাইলে, জীবনকে ভালোকরে জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই সফলতার গল্প পড়া উচিত।

আজকে এমন একজন সফল মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো যিনি বাংলাদেশের টপ ট্রাভেলারদের মধ্যে একজন। ১৯৯৬ সাল থেকে ট্রাভেল যাত্রা শুরু করেছেন, ২০২০ সালে এসেও থামেনি। ঘুরছেন, ঘুরতে থাকবেন এবং শেষ পর্যন্ত ঘুরবেনই এটাই যেন প্রধান লক্ষ্য দাঁড় করিয়েছে। শরীর ও মন সতেজ রাখা, ভালোবাসা, ভালোলাগা এবং জ্ঞান আহরণের কারণবশতই একজন ট্রাভেলার হওয়া।

মোহাম্মদ রিপন মিয়া, যার জন্ম স্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায়। অদম্য সাহস আর ইচ্ছা নিয়ে শুরু করেছেন ট্রাভেল যাত্রা। বাংলাদেশের প্রায় ৬৩টি জেলা ইতোমধ্যে ঘুরেছেন, শুধু মেহেরপুর জেলা বাকি রয়েছে, খুব শীঘ্রই মেহেরপুর জেলায় ভ্রমন করতে যাবেন। এছাড়াও তিনি বিদেশের অনেক আকর্ষণীয় ভ্রমণ স্পট গুলোতেও ঘুরে আসছেন।

তাহলে চলুন জেনে আসি, কিভাবে তিনি ভ্রমণপাগল হলেন এবং প্রায় পুরো বাংলাদেশ ঘুরেছেন। ট্রেন্ডি বাংলা থেকে বেশকিছু প্রশ্ন রেখেছি এবং তিনি খুব সুন্দরভাবে উত্তর দিয়েছেন।

কিভাবে শুরু করেছেন আপনার অসাধারন ট্রাভেল যাত্রা?

কিভাবে শুরু’ প্রশ্নটা নিরীহ হলেও, উত্তর খুবই জটিল! তবে যতটা মনে পড়ে, খুব ছোটবেলাতে মায়ের বকুনি খেয়ে রাগ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থেকে একা একা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল চলে গিয়েছিলাম। প্রায় একেবারে খালি পকেটে বের হয়েছিলাম। প্রথম ভ্রমণেই যে এত আকর্ষণীয় জায়গা ঘুরতে পারবো, কখনও চিন্তা করিনি।

বড় হয়ে জেনেছি, এদেশের `চায়ের রাজধানীর শ্রীমঙ্গল, অসাধারণ স্থান। পাহাড়ি এই এলাকায় মাইলের পর মাইল চা বাগান। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের চায়ের একটি অংশ এই বাগানগুলো থেকেই পাওয়া যায় এবং বিদেশে রপ্তানী হয়। এখানে চা বাগানের পাশাপাশি রয়েছে রাবার, লেবু ও আনারসের বাগান। বাংলাদেশের লেবুর চাহিদার বড় যোগান আসে শ্রীমঙ্গল থেকে। সবুজ প্রকৃতির মায়াবি রূপের কারণে শ্রীমঙ্গলের রয়েছে আলাদা পরিচিতি। শুধু দেশে নয়, বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছেও এই জায়গাটির কদর রয়েছে। ফলে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে শ্রীমঙ্গলের অবস্থান প্রথম সারিতে।

আর আমারও প্রথম এই জায়গা ঘুরার সৌভাগ্য হয়ে যায়। মুক্ত প্রকৃতি এবং নির্মল হাওয়ার জন্য শ্রীমঙ্গল হতে পারে আপনার প্রথম পছন্দ। তারপর ১৯৯৬ সালে ৬ জন বন্ধুদের সাথে সেন্টমার্টিন গিয়েছিলাম, আর তখন থেকেই আমার ভ্রমন যাত্রা ভালোভাবে শুরু করি।

সেন্টমার্টিন ট্যুরের ছবি, ১৯৯৬ সাল
প্রথম সেন্টমার্টিন ট্যুরের ছবি, ১৯৯৬ সাল

কোন কোন ট্রাভেল প্লেস গুলোতে ঘুরতে গিয়েছেন?

আলহামদুলিল্লাহ্! বাংলাদেশের অধিকাংশ ট্রাভেল প্লেসেই বেড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছে। এখন পর্যন্ত (২০১৯ সালের শেষ) দেশের ৬৩ টি জেলা ঘুরেছি। শুধু মেহেরপুরে এখনো যাওয়া হয়নি।

তারমধ্যে কক্সবাজারে ৮১ বার এবং বান্দরবানে ৪৫বার গিয়েছি। সমুদ্র ও পাহাড় দুটোই আমাকে টানে। এইজন্যই সমুদ্র ও পাহাড়ি এলাকায় যেতে মন চায় বার বার। অসম্ভন ভালো লাগে, শরীর ও মন সতেজ হয়ে যায়।

আমি যেসব সমুদ্রসৈকত উপভোগ করেছি –

১.কক্সবাজার
২.সেন্টমার্টিন
৩.ছেঁড়াদ্বীপ
৪.ইনানী
৫.পাথুয়াটেক
৬.সোনাদিয়া
৭.মহেশখালী
৮.টেকনাফ
৯.পতেঙ্গা
১০.বাঁশখালী
১১.বাঁশবাড়িয়া
১২.গুলিয়াখালী
১৩.দুবলারচর
১৪.পাথরঘাটা
১৫.ফাতরারচর
১৬.কুয়াকাটা
১৭.পাথরঘাটা
১৮.কুতুবদিয়া
১৯.নিঝুমদ্বীপ
২০.পারকি

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
দেবতাখুম, রোয়াংছড়ি
দেবতাখুম, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান

প্রকৃতির অপরূপ সৃষ্টি ঝর্ণা । আর এই ঝর্ণা তার রূপের সব পসরা সাজিয়ে হাজির হয় বর্ষাকালে। প্রতিটা ঝর্ণাই বর্ষাকালে অপরূপ সুন্দর।

আমার দেখা ঝর্ণা ও জলপ্রপাতঃ

১.হিমছড়ি (কক্সবাজার)
২.নাইট্যং (টেকনাফ)
৩.চিংড়ি (রুমা, বান্দরবান)
৪.নাফাখুম (রেমাক্রি, বান্দরবান)
৫.শুভলং (শুভলং, রাঙামাটি)
৬.জাদিপাই (রুমা, বান্দরবান)
৭.তৈদুছড়া-১(দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি)
৮.তৈদুছড়া-২(দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি)
৯.তোজেংমা (দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি)
১০.হাজাছড়া/শুকনাছড়া (বাঘাইছড়ি, রাঙামাটি)
১১.রিসাং (খাগড়াছড়ি)
১২.সুপ্তধারা (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম)
১৩.সহস্রধারা (সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম)
১৪.খৈয়াছড়া (মিরেরসরাই, চট্রগ্রাম)
১৫.নাপিত্তাছড়া (মিরেরসরাই, চট্রগ্রাম)
১৬.দামতুয়া (আলীকদম, বান্দরবান)
১৭.মাধবকুণ্ড (বড়লেখা, মৌলভীবাজার)
১৮.হামহাম (কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার)
১৯.ন’কাটা (বিলাইছড়ি, রাঙামাটি)
২০.ধুপপানি (বিলাইছড়ি, রাঙামাটি)
২১. ঋজুক ঝর্ণা (রুমা, বান্দরবান)
২২. তি দংখ খত(রোয়াংছড়ি, বান্দরবান)
২৩. তিনাপ সাইতার(রোয়াংছড়ি, বান্দরবান)
২৪. রিজার্ভ ফলস (রোয়াংছড়ি, বান্দরবান)
২৫. রূপসী ঝর্ণা (কমলদহ ট্রেইল, বড়দারোগার হাট)
২৬. ছাগলকান্দা ঝর্ণা(কমলদহ ট্রেইল, বড়দারোগার হাট)
২৭. পদ্ম ঝর্ণা (পদ্মঝিরি, থানছি, বান্দরবান)

জাদিপাই জলপ্রপাত, রুমা বান্দ
জাদিপাই জলপ্রপাত, রুমা বান্দরবান।
নাপিত্তাছড়া ট্রেইল, মিরসরাই, চট্টগ্রাম
নাপিত্তাছড়া ট্রেইল, মিরসরাই, চট্টগ্রাম

কেমন খরচ হয়েছে, কত দিন পর পর ট্যুরের প্লান করেছেন?

প্রতিটি ট্যুরেই খরচের দিকে বিশেষ দৃষ্ট রাখতে হতো। কারণ আমরা যারা অনেক বেশি ট্যুর করি, তাদেরকে খরচের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হয়। ট্রাভেল স্পট বেদে খরচের পরিমান ভিন্ন, তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখা অবশ্যই উচিত, ট্রাভেলের জন্য একটু বেশি টাকা নিয়েই বের হওয়া উচিত। নাহলে অনেক কিছু না দেখে আসতে হবে এবং পরিপূর্ণভাবে আনন্দও করা যাবে না।

ভ্রমণপাগলেরা কখনো নির্দিষ্ট সময় ধরে ট্যুরে খুব কমই যায়। আজকে ট্যুর থেকে এসেছি বলে আগামী ১৫দিন বা একমাস আর কোথাও যাওয়া যাবেনা, এমন কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। ভোরে বাস থেকে নেমে, আবার সেই রাতেই অন্য কোথাও রওয়ানা দেওয়ার ঘটনাও আছে। একবছরে প্রতিটি পূর্ণিমারাত সমুদ্রসৈকতে কাটানোর অভিজ্ঞতাও রয়েছে।

ছেঁড়াদ্বীপ, সেন্টমার্টিন
ছেঁড়াদ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কক্সবাজার

ভবিষ্যতে আর কোথায় যেতে চান?

বান্দরবানের গহীনে বেশকিছু ঝর্ণা এখনো উপভোগ করা বাকি আছে। তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাকলাই ঝর্ণা। সেনাবাহিনীর অনুমতি নেই বলে এখনো যেতে পারিনি। এই বর্ষাকালেই যাওয়ার খুব ইচ্ছে আছে। এছাড়াও মেহেরপুর জেলাটা দেখার বাকি আছে। আর পাহাড় ও সমুদ্র এলাকায় তো বার বারই যাবো।

 

ভ্রমন করা এত পছন্দ করেন কেনো?

আরেকটা নিরীহ প্রশ্ন! এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আমি আগেও অনেক ভেবেছি, কিন্তু যথার্থ উত্তর খুঁজে পাইনি! তবে আমার ক্ষেত্রে যা হয়, ভ্রমণে আমার মনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, মন পরিশুদ্ধ হয়।

ট্রাভেলিং করার মধ্যে ভালোলাগার কয়েকটা বিষয় বলেন।

ভ্রমণের সবচেয়ে ভালোলাগার বিষয় হচ্ছে অচেনা মানুষও আপন হয়ে যায়। এই যে একবার আপন হয়, শত ঝড়ঝাপটাতেও পর হয়না! তাছাড়া জ্ঞানবৃদ্ধি, অভিজ্ঞতা এসব তো রয়েছেই!

বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, তেতুলিয়া, পঞ্চগড়
বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, তেতুলিয়া, পঞ্চগড়

ট্রাভেলিং করার কিছু উপকারিতা তুলে ধরুন।

অসংখ্য উপকারিতা আছে। এই উপকারিতাগুলো দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে।

যেমন-

* মনের ক্লান্তি দূর হওয়া,
*নিজের মনের পৃথিবীকে আগের চেয়ে আরো একটু বড় করে নেওয়া,
*একঘেয়েমি থেকে মুক্তি,
*মুক্তির স্বাদ,
*অভিজ্ঞতা,
*জ্ঞানবৃদ্ধি,
* নিজের পরিচিত জগতে নতুন মানুষ যুক্ত হওয়া, ইত্যাদি।

শিমুলবাগান, তাহেরপুর, সুনামগঞ্জ
শিমুলবাগান, তাহেরপুর, সুনামগঞ্জ

যারা নতুনভাবে ট্রাভেল শুরু করতে চাই, তাদের জন্য কিছু উপদেশমূলক কথা বলুন, কিভাবে ট্রাভেলিং শুরু করা উচিত।

প্রশ্ন একটি, কিন্তু বটবৃক্ষের ন্যায় অনেকগুলো শাখাপ্রশাখা যুক্ত। তাই রঙধনু ন্যায় উত্তর দিচ্ছি। যার যে রঙ প্রয়োজন, সে যেন সেটাই খুঁজে নেয়।

স্বাভাবিক সামাজিক নিয়মনীতি মানলে ভ্রমণপাগল হওয়া সম্ভব না। পাখি হতে চাইলে মাটির টান ছাড়তে হবে, আকাশের সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে, এছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ নেই। পাগলের মতো ছুটে বেড়ানোর ইচ্ছা থাকতে হবে, এত সুন্দর পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখার জন্য মন থেকে চাইতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে।

প্রশ্নটা জটিল, কি চাই? এর উত্তর এর সাথে আরো একটা প্রশ্ন জড়িত। যা চাই তা চাইবার ‘ইচ্ছা’ আছে কিনা?
ভ্রমণপাগল হবার বিষয়টাও এমন, শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না, ইচ্ছে’টা থাকতে হবে। ভ্রমন করার স্বপ্ন সবাই দেখে কম বেশি, কিন্ত স্বপ্ন দেখলেই তো আর হবে না, অনেক ইচ্ছা ও আগ্রহ থাকবে হবে। ঘোরাঘুরি করার জন্য টাকার প্রয়োজন হয়, এইটা সবাই জানে। ভালো একটা ক্যারিয়ার এবং অদম্য ইচ্ছা শক্তির মাধ্যমেই অনেক আকর্ষণীয় ও অপরূপ ভ্রমণ স্পটগুলো উপভোগ করা যাবে।

আমার জীবন চলে উল্টো নিয়মে এটা যেমন সত্যি, ঠিক তেমনি এটা এক দিনে আলাদীনের চেরাগের মত পেয়ে গেছি তাও না। বহুবার শুনেছি তুমি কি ভাগ্যবান। জীবনে মনের মতো চাকরী পেয়েছো, অসাধারণ একটা মানুষ পেয়েছো।

তখন আমি প্রশ্ন করি, বিষয়টা কি আসলেই তাই?
চাকরী পাওয়ার আগে বা বিয়ে করার আগেও তো আমি এমনি ছিলাম।

চাকরী করার সময়টুকু ছাড়া বাকি সময়টা ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়াই, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই, প্রচুর বন্ধু আছে আমার। এই জীবন আমি বেঁছে নিয়েছি, মূল্য দিয়ে পেয়েছি! কাঁটায় হাঁটার ইচ্ছে আর সাহস না থাকলে গোলাপের সৌরভ মিলবে না। এটাই আমার ভ্রমণপাগল জীবনের রহস্য।

4 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here