ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ
ক্যান্সার কত প্রকার ও কি কি, ক্যান্সারের লক্ষণ ও চিকিৎসা

সারাবিশ্ব ব্যাপী ভয়ংকর এক অসুখের নাম ক্যান্সার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগের কোনও সঠিক চিকিৎসা নেই। তবে প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগটি ধরা পড়লে এবং সময়মত চিকিৎসা নিলে রোগটি থেকে বেচে যাওয়া সম্ভব হতে পারে। এই রোগ নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ করা সবচেয়ে বেশি কার্যকর উপায়।

তাই ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা ভীষন জরুরী একটি বিষয়। আমাদের সকলেরই ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ চিনে রাখা দরকার। তাছাড়া ক্যান্সার কেন হয় তা জানা থাকলে তা প্রতিরোধ করাও আমাদের জন্য সহজ হবে। মনে রাখতে হবে ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। এই ব্যয় সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা কষ্টকর। তাই আপনাদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যই আমাদের আজকের এই লেখা। এখানে আমরা জানব ক্যান্সার কত ধরনের, এবং ক্যান্সার হলে কি করনীয়। এছাড়া ক্যান্সার হলে কি কি খেতে হয় সেই সম্পর্কেও বিস্তারিত কথা বলব।

ক্যান্সার কত প্রকার ও কি কি?

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মানবদেহের কোষগুলির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকে ক্যান্সার বলে। ক্যান্সারকে ম্যালিগেন্সিও বলা হয়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে ১০০ টিরও বেশি ধরণের ক্যান্সার পাওয়া গিয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হল স্তনের ক্যান্সার, ত্বকের ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার ইত্যাদি। তবে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ক্যান্সারকে ৪ ভাগে ভাগ করা যায়।

• কার্সিনোমা: এই ক্যান্সার ত্বকে বা টিস্যুতে শুরু হয় যা অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলির আবরণ করে আক্রান্ত করে যেমন ত্বক, ফুসফুস, কোলন, অগ্ন্যাশয়, ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার ইত্যাদি।

• সারকোমা: হাড়, কারটিলেজ, চর্বি, পেশী, রক্তনালীগুলি বা অন্যান্য সংযোজক বা সহায়ক টিস্যুতে যে ক্যান্সার শুরু হয় তাই সারকোমা।

• লিউকেমিয়া: এই ক্যান্সার রক্তের গঠনের টিস্যুতে শুরু করে যেমন অস্থি মজ্জা এবং প্রচুর সংখ্যক অস্বাভাবিক রক্তকোষ তৈরি করে এবং রক্তে প্রবেশ করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে।

• লিম্ফোমা এবং মেলোমা: প্রতিরোধ ব্যবস্থার কোষগুলিতে যে ক্যান্সারগুলি শুরু হয় সে ধরনের ক্যান্সার কে লিম্ফোমা বলে।

• কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্যান্সার: মস্তিস্ক এবং মেরুদণ্ডের টিস্যুতে শুরু হওয়া ক্যান্সারগুলি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্যান্সার হিসেবে পরিচিত।

ক্যান্সারের লক্ষণ

ক্যান্সারের লক্ষণ ও লক্ষণ নির্ভর করে ক্যান্সারের ধরণের উপর, এটি কোথায় অবস্থিত, এবং যেখানে ক্যান্সারের কোষগুলি ছড়িয়ে পড়েছে তার উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, স্তনের ক্যান্সার স্তনে স্তনবৃন্তের প্রদাহ হিসাবে উপস্থিত হতে পারে, অন্যদিকে মেটাস্ট্যাটিক স্তনের ক্যান্সারে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্যান্সার গভীর পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত কোনও লক্ষণ প্রকাশ করে না।

আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি ৭টি লক্ষণ উল্লেখ করে যা ক্যান্সার আক্রান্ত একজন রোগীর শরীরে প্রকাশ পেতে পারে। লক্ষণগুলো হল-

১। হঠাত ত্বকে এমন ঘা দেখা দেয়া যা সহজে নিরাময় হয় না, পুজ জমা থাকে এবং ঘা শুকাতে দেরি করে। এগুলি মুখ বা ত্বকের ক্যান্সারগুলিকে ইঙ্গিত করতে পারে। এই ঘা প্রায়শই ব্যথাহীন থাকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাই দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

২। দেহের যে কোনও জায়গায় অস্বাভাবিক মাংসপিণ্ড হওয়া । এটি শরীরের ভিতরেও হতে পারে। বিশেষত কথাটি মহিলাদের এবং স্তনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অন্যদিকে পুরুষদের অণ্ডকোষে এমনটা হতে পারে।

৩। যদি কাশির সময় রক্তক্ষরণ হয়, তবে এটা ক্যান্সারের বড় লক্ষণ। এছাড়া স্ত্রী অঙ্গ (ভ্যাজিনা) বা মলদ্বার থেকে রক্তক্ষরণসহ এ ধরনের অন্যান্য অস্বাভাবিকতাও ক্যান্সারের উপসর্গ।

৪। আপনার অন্ত্রের মধ্যে নড়াচড়া যদি সহজ না হয় এবং মল স্বাভাবিকের চেয়ে বড় কিংবা কোনোভাবে অস্বাভাবিক মনে হয়, তাহলে তা মলাশয়ে ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী, প্রস্রাবে রক্ত এবং বেদনাদায়ক প্রস্রাব হওয়া এর সবগুলাই ক্যান্সারের লক্ষণ।

৫। আপনার যদি একটি অনবরত কাশি হতে থাকে তবে এটি ফুসফুসের ক্যান্সার বা গলার ক্যান্সারের লক্ষণ হতে প্রাথমিক পর্যায়ে, ফুসফুসের ক্যান্সার একটি নীরব রোগ। এটি এর উপস্থিতি সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যায়ে কোনও সতর্কতা দেয় না এবং এটি পরীক্ষার মাধ্যমেও পাওয়া যায় না। কাশি কিছু ক্ষেত্রে দেখা দেয় তবে অন্যের ক্ষেত্রেও না হতে পারে। ঘনঘন কাশি কিংবা কফের সঙ্গে রক্ত বের হলে দ্রুত চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা জরুরি।

৬। অধিকাংশ ব্যথাই ক্যান্সারের লক্ষণ নয়, তবে ঘন ঘন ব্যথা হলে তা চিন্তার বিষয়৷ তবে ক্রমাগত মাথাব্যথা হলে আবার এটা ভাবার কারণ নেই যে, কারো বুঝি ব্রেইন ক্যান্সার হয়েছে। কিন্তু বুকে ক্রমাগত এবং নিয়মিত ব্যথা ফুসফুসের ক্যান্সার কিংবা তলপেটে ক্রমাগত ব্যথা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। কোনো কারণ (যেমন জখম-আঘাত) ছাড়া যদি আপনি দীর্ঘদিন ধরে শরীরের কোনো স্থানে ব্যথায় ভোগেন, তবে তাতে ওষুধও কাজ না করলে এ নিয়ে ভাবনার কারণ আছে।

৭। কেউ খাবার খেলেই যদি নিয়মিত বদহজমে ভোগেন, তবে পেট, কণ্ঠনালী বা গলার ক্যান্সার নিয়ে ভাবনার কারণ আছে। অবশ্য সাধারণত এসব উপসর্গকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় না। তবু অসুস্থতাকে কখনো এড়িয়ে যেতে নেই।

ক্যান্সারের চিকিৎসা

ক্যান্সারের চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। তবে একটা কথা সত্য যে, প্রাথমিক অবস্থায় ধরা না পড়লে এই রোগের কোন চিকিতসাই শতভাগ কার্যকরী হয় না।

১। অস্ত্রোপচার

যে জায়গাটি ক্যান্সার আক্রান্ত হয় সেটির ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলো এবং তার আশেপাশের কোষগুলোকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কেটে সরিয়ে ফেলা হয়। ক্যান্সার যদি অল্প একটু জায়গা জুড়ে থাকে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে তাহলে এ ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়।

২। রেডিওথেরাপি

নিয়ন্ত্রিতভাবে শরীরের অংশবিশেষে তেজস্ক্রিয় রশ্মি প্রয়োগ করে সেই জায়গার কোষগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়।

৩। কেমোথেরাপি

এই ব্যবস্থায় ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করতে অ্যান্টি-ক্যান্সার (সাইটোটক্সিক) ড্রাগস বা ওষুধ ব্যবহার করা হয়। ৫০টিরও বেশি ধরনের কেমিওথেরাপি ওষুধ রয়েছে। এগুলোর কোনকোনটা ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল হিসেবে খেতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ওষুধগুলোকে স্যালাইনের সাথে বা অন্য কোনভাবে সরাসরি রক্তে দিয়ে দেয়া হয়। রক্তের সাথে মিশে এই ওষুধগুলো শরীরের যেখানে যেখানে ক্যান্সার কোষ রয়েছে সেখানে গিয়ে ক্যান্সার কোষগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে।

৪। হরমোন থেরাপি

শরীরের কিছু হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন করার মাধ্যমে এই চিকিৎসা করা হয়। শরীরের বৃদ্ধির সাথে হরমোনের একটা সম্পর্ক রয়েছে। কোন কোন ক্যান্সার এই হরমোনের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। ফলে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি কমিয়ে ক্যান্সারকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হরমোন থেরাপি ব্যবহৃত হয়।

৫। সহায়ক চিকিৎসা

ক্যান্সারের শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীদের মানসিক চিকিৎসার ব্যাপারে এখন জোর দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা বেশ মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যান, অনেকে মানসিকভাবে ভেঙ্গেও পরেন। এই কারণে অনেক সময়ে তাদের অবস্থা বেশি গুরুতর না হলেও অনেকে দ্রুত মারা যান। ফলে তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়ার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা এবং উন্নত দেশগুলোতে এ ধরনের সেবা দেয়ার জন্য বিভিন্ন সংগঠন কাজও করে যাচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ক্যান্সার আক্রান্তদের একটি গ্রুপ গঠন করা, যেখানে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে পারেন। এর পাশাপাশি যোগ, মেডিটেশন ইত্যাদির মাধ্যমেও রোগীদের মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার শিক্ষা দেয়া হয়। এর পাশাপাশি মানসিক স্বস্তির জন্য কেউ যদি ধর্মীয় বা সামাজিক কোন কাজে নিয়োজিত হতে চান সে ব্যাপারেও তাদেরকে উৎসাহ দেয়া হয়।

আশার কথা এই যে, প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করতে পারলে বেশিরভাগ ক্যান্সারেরই চিকিৎসা সম্ভব। পৃথিবীর অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েও বেচে গেছেন শুধুমাত্র প্রাথমিক অবস্থায় রোগটি সনাক্ত হয়েছিল বলে। তাছাড়া ধূমপান বা মদ্যপান ছেড়ে দেয়া বা পরিমাণ কমিয়ে এই রোগ থেকে বাচা যায়। প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি, ফলমূল এবং আঁশজাতীয় খাবার খাওয়া।অনেক সময় ক্যান্সারের লক্ষণসমূহ বোঝাও যায় না, এমনকি অন্য ক্যান্সারের চিকিৎসার পরবর্তী পরিণতি হিসেবে আরেক ক্যান্সার দেখা দেয়। তাই শরীরের যেকোনো অসুস্থতাকেই গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হবে। বিশেষ করে বয়স ৩০-৪০ বছর পেরিয়ে গেলে অবশ্যই প্রতি অর্ধবছর বা প্রতিবছর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here