ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো কী কী
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো কী কী

মশাবাহিত রোগগুলোর অন্যতম প্রাণঘাতি রোগ এই ডেঙ্গু। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই রোগটি অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ থাকে। কারণ এ সময়টিতে এডিস মশার বিস্তার ঘটে। এই সময়টিতে আমরা দেখতে পাই প্রচুর মানুষকে এই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন হাসপাতাল ভর্তি হতে।

এমনটি ও হয় যে, ডেঙ্গু আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা অত্যাধিক হওয়াতে সবাইকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়া ও সব সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। স্বাভাবিকভাবেই ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে মানুষের মাঝে প্রবল আতংক রয়েছে। যেহেতু অন্যান্য মশাবাহিত রোগের তুলনায় এই রোগে মৃত্যুর হার বেশি এবং চিকিৎসা ও ব্যয়বহুল ও জটিল, সেক্ষেত্রে ডেঙ্গু রোগ হওয়াটা প্রতিরোধ করাটাই এর থেকে বাচার অন্যতম উপায়। তাই সর্বপ্রথমে আমাদের জানতে হবে ডেঙ্গু রোগ কি এবং পরিশেষে আমরা জানব এই রোগ প্রতিরোধের উপায়।

ডেঙ্গু রোগ কি?

আসুন জেনে নেই ডেঙ্গু রোগ কি? এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ। সাধারণত এডিস ইজিপ্টাই নামক মশা দ্বারা এই রোগ মানুষকে সংক্রমিত করে। এই মশা যখন একজন মানুষকে কামড়ায় তখন এই রোগের ভাইরাস মশার থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে। এই ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করলে অসুখটি প্রাণঘাতী ডেঙ্গু হেমোর‍্যাজিক ফিভারে পরিণত হয়। তখন শরীরে প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকার পরিমাণ আশংকাজনক হারে কমতে থাকে। সেক্ষেত্রে রক্ত থেকে প্ল্যাটিলেট বা রক্তকণিকা আলাদা করে তা রোগের শরীরে দিতে হয়।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক অধ্যাপক ডঃ মিয়া এনায়েত উল্লাহ বলেন, “ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণ জ্বরের মতই, তবে রোগটি তীব্র আকার ধারণ করলে অন্যান্য আরও লক্ষণ প্রকাশ পায়। এই জ্বর অনেক ক্ষেত্রে কম হতে পারে আবার বেশিও হতে পারে। দেখা যায় জ্বর তিন-চার দিন পর ভালো হয়ে যায়।“ তিনি আমাদেরকে সুস্পষ্টভাবে এই লক্ষণ গুলো জানিয়েছেন যা থেকে আমরা বুঝতে পারব একজন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কিনা। নিম্নে লক্ষণগুলো তুলে ধরা হল-

• এই রোগের সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হল প্লাটিলেট এর সংখ্যা কম হতে থাকা। তাই শুরুতেই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে হবে রোগীর শরীরে প্লাটিলেট বা রক্তকণিকার পরিমাণ কত।

• ডেঙ্গুতে তে রোগীর তীব্র জ্বর হয় আবার চলেও যায়। শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ করে ১০৪ ডিগ্রি-১০৬ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। ছোট একটি বিরতি দিয়ে রোগীর শরীরে আবার জ্বর আসে। এই জ্বরের সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা এবং চোখের পেছনে ব্যথা করবে। জ্বর সাধারণত দুই বা তিন দিন থাকার পর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় র‍্যাশ বা গোটা দেখা যায়।

• জ্বর যদি জটিল পর্যায়ে চলে গেলে, মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। এমনকি একজন ডেঙ্গু রোগীর রক্তবমিও হতে পারে। পায়খানার সঙ্গে রক্ত অথবা কালো কিংবা লালচে কালো রঙের পায়খানা হতে পারে। পাকস্থলীর উপরিভাগে পানি চলে আসতে পারে। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার খুবই মারাত্মক। এতে মস্তিস্কেও রক্তক্ষরণ হতে পারে।

• অরুচি, বমি বমি ভাব দেখা দিতে পারে। রোগীর চোখ লাল হতে পারে এবং ত্বকও লাল হতে পারে। এই জ্বরে যেহেতু পানিশূন্যতা বেশি হয়, তাই প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যেতে পারে। এতে কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঘাম হতে পারে। অন্যান্য ভাইরাস জ্বরের প্রায় সকল লক্ষণই এই ডেঙ্গু জ্বরে দেখা যেতে পারে।

• রোগীর শরীরে খিচুনী দেখা দিতে পারে। রক্তের স্পন্দন কমে যেতে পারে এমনকি অনেক ক্ষেত্রে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে।

ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার কিভাবে করব?

সাধারনত ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার দুই ভাবে করা যায়- এক) চিকিৎসা, দুই) প্রতিরোধ। আমরা পর্যায়ক্রিমকভাবে এই দুইটি উপায় আলোচনা করব।

চিকিৎসাঃ

সরকারের কমিউনিক্যাবল ডিজিজ কন্ট্রোল বা সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ বিভাগের অন্যতম পরিচালক ডঃ হাসিমা বেগম বলেন, ”জ্বর হলে বিশ্রামে থাকতে হবে। আমি পরামর্শ দেই, জ্বর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করা থেকে বিরত থাকতে। সত্যিকথা বলতে কি ডেঙ্গুর প্রকৃতপক্ষে কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। উপসর্গ অনুযায়ী রোগের চিকিৎসা করা হয়।“ তিনি আর বলেন, বেশির ভাগ ডেঙ্গু জ্বরই সাতদিনের মধ্যে সেরে যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ মারাত্মক পর্যায়ে ও যায় না। বার বার মাথায় পানি দেয়া অন্যান্য জ্বরের মত ডেঙ্গুতে ও ভাল কাজ দেয়।

এছাড়া জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। উপসর্গভেদে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অন্যান্য কি কি ওষুধ খাবেন তা নির্ধারণ করে দিবেন। তবে ব্যথানাশক ওষুধ হিসেবে এসপিরিন বা ক্লোফেনাক জাতীয় ওষুধ দেওয়া যাবে না। এতে রক্তক্ষরণ বেড়ে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হতে পারে। হেমোরেজিক ফিভার অনেক মারাত্মক এতে মৃত্যুও হতে পারে। তবে আশার কথা ডেঙ্গু এই আকার ধারণ করে খুবই কম ক্ষেত্রে। তাই এমন যদি হয় যে রোগীর জ্বর হয়েছে সাথে রক্তক্ষরণ ও হচ্ছে তা দেখামাত্র অতি দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে বিশেষ চিকিৎসার জন্য। এই ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যে রোগীর কোথাও যেন কেটে না যায়, কারণ এই রোগ হলে শরীরে রক্ত জমাট বাধে না। তাই কাটলে তীব্র রক্তক্ষরণ হতে পারে । এক্ষেত্রে রোগীকে শিরাপথে সেলাইন, প্রয়োজনে রক্তের প্লাটিলেট ট্রান্সফিউশন করতে হবে।

ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীকে সবসময় মশারির মধ্যে থাকা উচিত। কারণ এসব রোগীকে কোনও একটি এডিস মশা কামড় দিলে সেই মশাটিও ডেঙ্গুর জীবাণু বাহক হয়ে পড়বে এবং তখন মশাটি সুস্থ কোনও ব্যক্তিকে কামড় দিলে সুস্থ ব্যক্তিটিও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে।

প্রতিরোধঃ

সব্ চেয়ে প্রথমে যেই কাজটি করতে হবে তা হল বাড়ির আশ্পাস পরিস্কার রাখা। কোথাও যেন পানি জমে থাকতে না পারে সেই দিকে লক্ষ রাখা। কারণ জমে থাকা পানি এডিস মশার বংশ বৃদ্ধির একমাত্র উপায়। তাই ফুলদানি, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত জিনিস যেমন মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে,সে ব্যবস্থা করতে হবে। এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনে ঘরের চারদিকে দরজা জানালায় নেট লাগাতে হবে। দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধের মূল অস্ত্রই হল এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এইসব জায়গা গুলোতে মশা নিধক ওষুধ ছিটিয়ে দিতে হবে।

ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খাওয়া উচিত?

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক অধ্যাপক ডাঃ মনোয়ার হোসেন বলেন, “ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে বেশি বেশি তরল খাবার দিতে হবে। দিনে অন্তত আড়াই লিটার থেকে তিন লিটার পানি অবশ্যই পান করতে হবে। তরল খাবার ডেঙ্গু রোগীর জন্য অত্যন্ত দরকারী। তাই তরল খাবার হিসেবে স্যালাইন, ডাবের পানি যত বেশি খাওয়া যায় ততই মঙ্গল।“ তিনি আরও বলেন, “বিভিন্ন ধরনের সবজি থেঁতো করে জুস করে খেলে খুবই উপকার হবে। খাদ্যতালিকায় আমিষ থাকতে হবে বেশ ভাল পরিমাণের। দুধ, ডিম ও এগুলোর তৈরি নানা খাবার, মাছ ও মুরগি খেতে হবে। তবে এই খাবার গুলোতে অতিরিক্ত তেল মশলা দেয়া যাবে না। নানা ধরনের ভেষজ খাবারের উপকারিতা আছে। যেমন পেঁপে পাতা অণুচক্রিকা বাড়াতে সাহায্য করে বলে ডেঙ্গুতে উপকারী। তাই প্রতিদিন পেপে পাতার রস খাওয়া যেতে পারে।“

একটু সতর্ক থাকলেই ডেঙ্গু থেকে বেচে থাকা যায়। ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here