চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর থেকে উৎপত্তি হওয়া রহস্যময় করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েই চলেছে। গত কয়েকদিন ধরে নতুন এ ভাইরাস সারা পৃথিবীর মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রতিদিন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আজকে এই আর্টিকেল থেকে আমরা করোনা ভাইরাস ও এর প্রতিরোধ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।  

করোনা ভাইরাস কি?

করোনা ভাইরাস হচ্ছে অনেক গুলো সংক্রামক ভাইরাস এর সমষ্টি যা যেকোনো প্রাণী বা মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। করোনা ভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু সব প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে না, মাত্র ছয়টি প্রজাতি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। 

কোভিড-১৯ (COVID-19, যা ‘করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ) , যা করোনা ভাইরাসের একটি প্রজাতি। চিনের উহান শহরে মহামারি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ভাইরাসটি মানুষের কাছে অজানা ছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সকল গণমাধ্যমের শিরোনামে প্রাধান্য বিস্তার করেছে এর ভয়াবহতার জন্য। যার আতঙ্কে রাতের ঘুম হারাম হয়েছে গোটা বিশ্বের। পৃথিবীর সকল চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ঘেঁটেও এই ভাইরাস প্রতিরোধের উপায় খুঁজে পাছে না এবং এখন পর্যন্ত কোন ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়নি ।

করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিঃ 

চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডঃ জিওঘেঘানের মতে, বন্য প্রাণী থেকে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। এই বিজ্ঞানীর অনুমান বাঁদুরের শরীর থেকে এই ভাইরাস এসে থাকতে পারে। তবে এই ব্যপার নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে অন্য কোন জন্তুর শরীর থেকে এই ভাইরাস আসতে পারে। তাই এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো খবর জানা যায়নি এই ভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে। কোথা থেকে এই ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছে জানা গেলে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে অনেকটাই সহজ হবে 

করোনা ভাইরাসের লক্ষণ বা উপসর্গঃ 

শ্বাসতন্ত্রের অন্যান্য অসুস্থতার মতো এই ভাইরাসের প্রধান লক্ষণগুলো হল সর্দি, শুঁকনো কাশি, গলা ব্যথা এবং জ্বর দেখা যায়। অনেক সময় ডায়রিয়া দেখা দিতে পারে।পরে এটি ফুসফুসে আক্রমণ করে। কিন্তু এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে গিয়ে , নিউমোনিয়া এবং মৃত্যুও  ঘটতে পারে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক লক্ষণঃ 

  • জ্বর
  • অবসাদ
  • শুষ্ক কাশি
  • বমি হওয়া
  • শ্বাসকষ্ট
  • গলা ব্যাথা
  • মাথা ব্যাথা
  • পেটের সমস্যা

সাধারণত  শুষ্ক কাশি ও হাল্কা জ্বরের মাধ্যমেই শুরু হয় উপসর্গ দেখা দেয়, পরে ধীরে ধীরে ভাইরাস যখন ফুসফুসে আক্রমণ করে তখন শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গগুলো প্রকাশ পেতে গড়ে পাঁচদিন সময় নেয় এবং অনেক সময় ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়ে থাকলেও কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভাইরাসটির ইনকিউবেশন পিরিয়ড ১৪দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকে অর্থাৎ ১৪ দিন সময় লাগে পুরোপুরি ভাবে উপসর্গ প্রকাশ পেতে বা আপনি যে সংক্রমিত হয়েছেন এটা বুঝতে আপনাকে ১৪ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এই জন্যেই সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে ১৪ দিন কোরাইন্টাইনে থাকার জন্য বলা হয়।  তবে কিছু কিছু গবেষকের মতে এর স্থায়িত্ব ২৪দিন পর্যন্ত থাকতে পারে।

ভাইরাসটির সংক্রমণের শুরুর দিকের উপসর্গ সাধারণ সর্দিজ্বর এবং ফ্লু’য়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়ায় রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া স্বাভাবিক। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বয়স্ক মানুষ ও আগে থেকে যারা দীর্ঘমেয়াদী অসুখে অসুস্থ তাদের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। 

করোনা ভাইরাস কিভাবে ছড়ায় ?

করোনা ভাইরাস মূলত বাতাসে Air Droplet মাধ্যমে ছড়ায়। এই ভাইরাস টি অত্যন্ত দ্রুত ছড়াতে পারে এবং বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করে বলেছে  যে এ ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে খুব ছড়াতে পারে এবং সংক্রমিত করতে পারে। 

এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেক জনের দেহে খুব সহজে সংক্রমিত হতে পারে। যা সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। 

কোভিড-১৯ রোগটি বা করোনা ভাইরাস মূলত কোনো ব্যক্তি কথা বলার সময় অথবা হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় তার মুখ থেকে যে ক্ষুদ্র পানির কণা বের হয়ে আসে তা কোনো সুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে গেলে কোভিড-১৯ একজন থেকে আরেক জনের মধ্যে ছড়ায় । 

কোভিড-১৯ এ  আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে

কোভিড-১৯ বা নোভেল করোনা ভাইরাসের সব থেকে ভয়ংকর দিক হচ্ছে এটি সরাসরি শ্বাসনালী ও ফুসফুসকে আক্রমণ করে। সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাওয়া মানুষের ফুসফুস অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা কমে গিয়েছে ২০-৩০ শতাংশ। 

একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ফুসফুসে প্রায় ৪৮ কোটি অ্যালভিওলাই থাকে। ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে ফুসফুসে অবস্থিত অ্যালভিওলাইগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই ক্ষতিপূরণ হওয়া অনেকটাই অসম্ভব ।তবে, যাঁরা ধুমপায়ী তাঁদের শ্বাসনালী ও ফুসফুস আরো  বেশিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধুমপায়ী ব্যক্তিদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি।ধুমপায়ী ব্যক্তি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে অধূমপায়ী ব্যক্তির তুলনায় নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ১৪% বেশি। তাই এই মহামারিতে ধূমপান করা থেকে বিরত থাকা অত্যান্ত জরুরী। 

করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর কি কোন চিকিৎসা আছে?

কোভিড-১৯ বা নোভেল করোনা ভাইরাসটি চিনের উহান শহরে মহামারি শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষের কাছে অজানা ছিল। তাই এই ভাইরাস নিয়ে পূর্বে কোনো গবেষণা হয়নি ফলে এর কোন টিকা বা ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কার হয়নি। এবং এই ভাইরাসের কোনো ফলপ্রসূ চিকিৎসাও নেই। 

করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পাবার উপায়

যেহেতু এই রোগের ভ্যক্সিন বা প্রতিকার আবিষ্কার হয়নি তাই বিস্তার প্রতিরোধই একমাত্র উপায় এই রোগ থেকে রক্ষা পাবার অর্থাৎ যারা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছে বা এ ভাইরাস বহন করছে – তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা। আশার কথা এই রোগ থেকে ৮০% লোকই সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। তাই প্রতিরোধ করা অত্যন্ত জরুরী। 

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের উপায়ঃ 

১। বাসায় থাকলে বার বার সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড সময় ধরে ভালো করে ঘষে ঘষে হাত ধুতে হবে। 

২। কর্মস্থলে থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে রাখতে হবে। 

৩। বাইরে থেকে বাসায় প্রবেশের সাথে সাথে হাত স্যানিটাইজ করতে হবে অথবা সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। সম্ভব হলে হাল্কা গরম পানি দিয়ে গোসল করে নেয়া ভালো। 

৪। হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা এবং বাইরে গেলে মাস্ক পরিধান করা। 

৫। খুব বেশি দরকার না হলে বাইরে না যাওয়া এবং জনসমাগমস্থল ও গণপরিবহণ এড়িয়ে চলা। 

৬। হাঁচি- কাশি দেওয়ার সময় রুমাল বা টিস্যু দিয়ে মুখ চেপে রাখা এবং অন্যের হাচি-কাশি থেকে দুরে থাকা।

৭। সর্দি, কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন।

৮। একজন আরেকজন থেকে ৬ ফিট দূরত্ব বজায় রেখে চলা, হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি ও জড়িয়ে ধরা থেকে বিরত থাকা। 

৯। ডায়াবেটিস, হাঁপানি, কিডনি ও উচ্চরক্তচাপের রোগীদের রোগ নিয়ত্রনে রাখা অত্যন্ত জরুরী। এদের হোম কোয়ারান্টাইনে থাকাই ভালো। কারণ অন্যান্যদের তুলনায় এইসব লোকের ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশাংকা বেশি। 

১০। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে দৈনিক এমনসব খাবার গ্রহণ করা উচিত। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন (১০-১২ গ্লাস) ।

করোনা ভাইরাস অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ভাইরাস কিন্তু শুধুমাত্র সংক্রমিত মানুষ বা বস্তু থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেই এই ভাইরাস থেকে পুরোপুরি রক্ষা করা সম্ভব। এছাড়া এটি একটি ভারী ভাইরাস, তাই বাতাসের দ্বারা ছড়ায় না। তাই মাস্ক ব্যবহার খুব বেশী কাজে দিবে না। এটি হাতের সাহায্যে বা সংস্পর্শে ছড়ায়। সুতরাং চোখ, মূখ, নাক হাত না ধূয়ে স্পর্শ করা যাবে না এবং যথাসম্ভব বাড়িতে অবস্থান করা উচিত। 

ভয় পাবেন না। করোনা সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ আপনার হাতে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। গুজবে কান দেবেন না।আমোদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (immune system) এর কারণে এমনিতেই ৭-১০ দিনে করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। তবে গুরুতর শাররীক সমস্যা থাকেলে ভেন্টিলেশন দরকার হতে পারে। তা কেবল ৩.৫ থেকে ৫ শতাংশের বেলায়। বেশি করে শাকসবজি ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খাবেন। বিশেষ করে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বেশী খাবেন। ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

পরিশেষে, মনে রাখবেন আপনার পরিবার যথেষ্ট সতর্ক থাকা সত্ত্বেও কেবল আপনার কারণে করোনা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। সব সময় সাবধানতা অবলম্বন করুন এবং নিজে সংক্রমণ থেকে বাঁচুন, পরিবারকে বাঁচান, সমাজকে বাঁচান, দেশকে বাঁচান।

এছাড়াও, স্বাস্থ্যবিষয়ক আর্টিকেল পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here