থাইরয়েড রোগের লক্ষণ
থাইরয়েড রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

থাইরয়েড একটি হরমোন গ্রন্থি। এটা গলার সামনে থাকে। থাইরয়েডের প্রধান কাজ শরীরে হরমোন তৈরি করা। এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গে গঠনে সহযোগিতা করে থাইরয়েড। থাইরয়েড হরমোন দেহের প্রয়োজনের চেয়ে কম তৈরি হলে বলি হাইপো-থাইরয়েড এবং বেশি হলে বলি হাইপার থাইরয়েড রোগ। বর্তমানে পৃথিবীতে থাইরয়েড সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক।

আমরা অনেকে এই রোগের নাম শুনলেও বা আশেপাশে আক্রান্ত রোগী দেখলে কিংবা নিজে আক্রান্ত হলেও আমরা এই রোগ সম্পর্কে অনেকেই খুব একটা জানিনা। থাইরয়েড রোগের লক্ষণ মানুষের শরীরে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পায়। মনে রাখা দরকার থাইরয়েড সমস্যা সমাধান বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল।

এ রোগটি কিন্তু অন্যসব সাধারন রোগের মতও নয়। কারন এর লক্ষণগুলো খুব ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। কিন্তু এর ফল অনেক বেশী ক্ষতিকর। আর এই রোগ খুব ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় বলে বেশির ভাগ রোগী তা জানেই না যে সে এই রোগটা বহন করছে। আমেরিকার মত উন্নত দেশে ২৭ মিলিয়ন থাইরয়েড রোগী আছে আর তার ৫০ ভাগের বেশী লোকই তা জানে না যে তার এই রোগ আছে। যেহেতু এর ফলাফল কিছু ক্ষেত্রে খুব মারাত্মক তাই আসুন জেনে নিই কিভাবে বুঝব আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছি কি না।তাই প্রাথমিক পর্যায়ে এর চিকিৎসা হওয়া ভাল। আজকে আমরা থাইরয়েড রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার এর উপায় সম্পর্কে জানব।

থাইরয়েড রোগের লক্ষণ গুলো কি কি এবং থাইরয়েড কি কি কারনে হয়

শুরুতেই আমাদের জানতে হবে যে থাইরয়েডের পাচটি প্রধান রোগ রয়েছে। আমার পর্যায়ক্রমিক ভাবে লক্ষণসহ রোগগুলি নিয়ে আলোচনা করব।

১। হাইপোথাইরয়েডিজম

হাইপোথাইরয়েডিজমের ফলাফল থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে অপর্যাপ্ত পরিমাণ থাইরয়েড হরমোন উত্পাদন করে। এটি থাইরয়েড গ্রন্থি, পিটুইটারি গ্রন্থি বা হাইপোথ্যালামাসের মধ্যে সমস্যা থেকে বিকাশ লাভ করতে পারে। থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় কম হরমোন উৎপাদন করে তখন হাইপোথাইরয়ডিজম হবার সম্ভাবনা আছে। যদিও অনেক সময় এর চোখে পড়ার মত লক্ষণ দেখা যায়না, যার ফলে অনেকে বুঝতেই পারেন না তারা হাইপোথাইরয়ডিজম এ আক্রান্ত। যেটা হাইপারথাইরয়ডিজম নামে পরিচিত। হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:

• অবসাদ
• দুর্বল ঘনত্ব বা মানসিকভাবে “কুয়াশাচ্ছন্ন” বোধ
• শুষ্ক ত্বক
• কোষ্ঠকাঠিন্য
• ঠাণ্ডা লাগছে
• তরল ধারণ
• পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা
• বিষণ্ণতা
• মহিলাদের দীর্ঘায়িত বা অতিরিক্ত মাসিক রক্তপাত হয়

২। হাইপারথাইরয়েডিজম

হাইপারথাইরয়েডিজম থাইরয়েড হরমোনের অতিরিক্ত উৎপাদন বর্ণনা করে যা হাইপোথাইরয়েডিজমের চেয়ে কম সাধারণ অবস্থা। হাইপোথাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলি সাধারণত বর্ধিত বিপাকের সাথে সম্পর্কিত। হালকা ক্ষেত্রে, আপাত লক্ষণগুলি নাও থাকতে পারে। হাইপোথ্যালামাস, পিটুইটারি গ্রন্থি এবং থাইরয়েড গ্রন্থির মিলিত প্রচেষ্টায় হরমোন নির্গমণ কাজ সম্পন্ন হয়। এখন উক্ত ৩ টি গ্রন্থির যে কোনো একটি বা একাধিক গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কাজ করে ফেলে তখন ফলাফল হিসেবে যতটুকু হরমোন দরকার তার চেয়ে বেশি পরিমাণ হরমোন উৎপন্ন হয়। আর তখনই বাঁধে সমস্যা। যেটা হাইপারথাইরয়ডিজম নামে পরিচিত।হাইপারথাইরয়েডিজমের লক্ষণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:

• কম্পন
• স্নায়বিক দুর্বলাবস্থা
• দ্রুত হার্ট রেট
• অবসাদ
• গরমে অসহিষ্ণুতা
• অন্ত্রের গতিবিধি বৃদ্ধি
• ঘাম বেড়েছে
• ঘনত্বের সমস্যা
• অনিচ্ছাকৃত ওজন হ্রাস

৩। গলগণ্ড

গলগণ্ড কোনও কারণ ছাড়াই থাইরয়েড গ্রন্থির প্রসারকে সহজভাবে বর্ণনা করে। গলগণ্ড নির্দিষ্ট কোন রোগ নয়। গলগণ্ড হাইপোথাইরয়েডিজম, হাইপারথাইরয়েডিজম বা সাধারণ থাইরয়েড ফাংশনের সাথে যুক্ত হতে পারে। আয়োডিনের অভাব হলে গ্রন্থিটি হরমোন তৈরি করতে পারেনা ঠিকভাবে। তবুও এটি চেষ্টা করে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি করতে। থাইরয়েড হরমোন বেড়ে গেলে কী হয় তার বড় প্রমাণ এই রোগ। ফলস্বরূপ এটি নিজে বড় হয়ে যায় শরীরের হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে। এবং একটা সময় এটি আর পারেনা সেই স্বাভাবিক মাত্রায় হরমোন তৈরি করতে। ফলে হরমোন এর পরিমাণ কমে যায় প্রয়োজনের তুলনায়। এবং ফলাফল হিসেবে উক্ত ব্যক্তি হাইপোথাইরয়ডিজম এ আক্রান্ত হয়। এজন্য যেসব শিশু বা মানুষ আয়োডিন এর স্বল্পতায় ভুগে তাদের এই রোগ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে বর্তমানে লবণের সাথে আয়োডিন গ্রহণের ফলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব অনেকাংশেই কমে এসেছে।

৪। থাইরয়েড নোডুলস

নোডুলস থাইরয়েডের মধ্যে গলদা বা অস্বাভাবিক জনসাধারণ। নোডুলস সৌম্য সিস্ট, সৌম্য টিউমার দ্বারা বা সাধারণত কম দেখা যায় থাইরয়েডের ক্যান্সারের কারণে হতে পারে। নোডুলস একক বা একাধিক হতে পারে এবং আকারে বিভিন্ন হতে পারে। যদি নোডুলগুলি অত্যধিক পরিমাণে বড় হয় তবে তারা কাছের কাঠামোর সংকোচনের সাথে সম্পর্কিত লক্ষণ সৃষ্টি করতে পারে। এক্ষেত্রে এই টিউমার সংখ্যায় এক বা একাধিক হতে পারে। এবং বিভিন্ন আকারের হতে পারে। তবে টিউমার হলেই সবক্ষেত্রে ক্যান্সার হয়না। তবে অবস্থা বেশি খারাপ হলে এবং কোনো চিকিৎসা না নেয়া হলে এটি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। যাকে বলা হয় থাইরয়েড ক্যান্সার।

৫। থাইরয়েড ক্যান্সার

পুরুষদের বা যুবকদের চেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সার অনেক বেশি সাধারণ। ৫৫% এর কম বয়সীদের মধ্যে প্রায় ২/৩ কেসে দেখা যায় থাইরয়েডের মধ্যে নির্দিষ্ট কোষের ধরণের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধরণের থাইরয়েড ক্যান্সার রয়েছে যা ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসাজনিত কারণেও এই অসুখ হতে পারে। অপারেশনের কারণে থাইরয়েড গ্ল্যান্ড বাদ দিতে হলে বা অন্য কারণেও থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে। থাইরয়েড ক্যান্সারের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাল প্রাগনোসিস এবং উচ্চ বেঁচে থাকার হার থাকে, বিশেষত প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে।

থাইরয়েড ক্যান্সারের লক্ষণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
• গলার সম্মুখভাগে ফুলে ওঠে, ফোলা অংশটা বেশ শক্ত হয়।
• একটি বা একাধিক টিউমার হতে পারে, উভয় পাশে টিউমার হতে পারে ও আশপাশের লিম্ফ নোডগুলো ফুলে উঠতে পারে।
• কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যথা হতে পারে এবং স্থানটা লাল হতে পারে। এর ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
• ওজন কমে যায়, খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে এবং কোনো কিছু খেতে বা ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়।
• কাশি হতে পারে, গলার ভেতরে চুলকাতে পারে।
• গলার স্বর পরিবর্তন হতে পারে। গলার স্বর মোটা বা ফ্যাসফেসে হতে পারে।

থাইরয়েড রোগের প্রতিকার

থাইরয়েড ক্যান্সার এমন একটি রোগ, যা সময়মতো চিকিৎসা করলে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায়। গলার সামনে ফুলে উঠলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি একজন ডাক্তার দেখানো উচিত। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন এটা কোন ধরণের রোগ। ক্যান্সার শনাক্ত হলে বা ক্যান্সার আছে এমন সন্দেহ হলে অতিদ্রুত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ বা গলার অপারেশনে পারদর্শী কোনো সার্জনের কাছে যেতে হবে। রোগীকে সম্পূর্ণ মূল্যায়নের জন্য এফটিথ্রি, এফপিফোর, টিএসএইচ, থাইরয়েড গ্রন্থির আল্ট্রাসনোগ্রাম, এফএনএসি ও থাইরয়েড বায়োপসি করার পরামর্শ দেয়া হয়।

কিছু ক্ষেত্রে থাইরয়েড স্ক্যান করার প্রয়োজন হতে পারে। থাইরয়েড স্ক্যান করার পর যদি কোনো একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেডিও আয়োডিন বেশি জমে, তবে এটাকে বলে হট নোডিউল। যদি রেডিও আয়োডিন অন্যান্য স্বাভাবিক এলাকার চেয়েও কম জমা হয়, তবে এটা কোল্ড নোডিউল। এসব কোল্ড নোডিউলগুলোতেই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। থাইরয়েড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা হচ্ছে অপারেশন বা সার্জারি করা। আক্রান্তের ধরনের ওপর নির্ভর করবে থাইরয়েড গ্রন্থির কতটুকু কাটতে হবে। অনেক সময় পুরো থাইরয়েড গ্রন্থি কেটে ফেলার প্রয়োজন হতে পারে।

একে বলে টোটাল থাইরয়েডেকটমি। অপারেশন করে আক্রান্ত অংশ ফেলে দেওয়ার পর সেখানে আর কোনো ক্যান্সার সেল যেন না থাকে তার জন্য রেডিও আয়োডিন থেরাপি বা কখনো কখনো রেডিওথেরাপি দেওয়া লাগতে পারে। এরপর কোনো কোনো রোগীকে আজীবন থাইরয়েড হরমোন সেবন করতে হতে পারে। লেভোথাইরক্সিন দিয়েও অনেক সময় এর চিকিৎসা করা হয়। অনেক সময় টিএসএইচ হরমোন নোডিউল বা টিউমারের বৃদ্ধিতে উত্তেজক পদার্থ হিসেবে কাজ করে। তাই এই হরমোনের পরিমাণ কমাতে পারলে টিউমার বা ক্যান্সারের আকার আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যায়।

পরিশেষে বলা যায়, এই রোগ অনেক জটিল। তাই থাইরোয়েড রোগের লক্ষণ জেনে রাখা দরকার। মনে রাখা ভালো যে থাইরয়েড অস্ত্রপাচার অনেক সর্তকতার সঙ্গে করতে হয়। এবিষয়ে যারা সবচেয়ে প্রবীণ ও অভিজ্ঞ তাদের দিয়ে অস্ত্রপাচার করাই ভাল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here